ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বিদেশি বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সৈয়দ এরশাদ আহমেদ মনে করেন, এফডিআই-এর জন্য একটি ভালো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তবে প্রধান সমস্যাগুলি হলো ব্র্যান্ডিং এবং বন্দরের অটোমেশন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি একটি সুখবর দিয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়ের সাথে সাথে বিদেশি বিনিয়োগও বেড়েছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলার (৪.৭১ বিলিয়ন ডলার) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই এসেছে ৬১ শতাংশ বেশি, যা গত অর্থবছরে ২.১৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছিল, আর নিট এফডিআই ছিল ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার।
দীর্ঘমেয়াদী করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতিতে হতাশা এবং আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তবে বিদেশি বিনিয়োগের এই উল্লম্ফন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী নেতারা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং না হওয়া এবং বন্দরের অটোমেশন না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগকে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সরকার কাজ করছে। বর্তমানে নতুন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সেবার একটি বড় অংশ সরকার ডিজিটালাইজড করেছে, ফলে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা অনলাইনে নিবন্ধনসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে পারছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, আমদানি ব্যয় বেড়ে ডলারের সংকট দেখা দিলেও বর্তমানে আমদানি কমছে, রফতানি এবং প্রবাসী আয় বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলোর ফলে আগামী দুই মাসের মধ্যে অর্থনীতির চাপ কমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল, যার মধ্যে নিট বিনিয়োগ ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে, যার মধ্যে নিট এফডিআই ছিল ২৬৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর, যেখানে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে।
আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনতে জাপান টোব্যাকো প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন খাতে যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অংশকে নিট এফডিআই বলা হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, যা ঘিরে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ বেড়েছে। ফলে শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি, পরিবহন খাতের যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতে আমদানি বেড়েছে, যার ফলে দেশের বিনিয়োগের পরিমাণও অনেক বেড়েছে।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ে, যা বর্তমানে দেশে ঘটছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর চেয়েও বেশি অবদান রাখবে। দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। ফলে দেশি বিনিয়োগের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও বেড়েছে।
বিনিয়োগের হার কয়েক বছর ধরে জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল। করোনার সময় সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছিল, কিন্তু বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এখন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করছেন। এ কারণেই আমদানি বেড়েছিল। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১৩.৬৬ শতাংশে উঠেছে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বাধিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮২.৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। তবে আমদানির খরচ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ প্রায় ৩২ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ১৫.১২ শতাংশ কমেছিল। তবে জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২.১০ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা ১৪ মাসের মধ্যে সর্বাধিক। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বাড়তে শুরু করেছে। ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১.৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল, কিন্তু বর্তমানে তা বাড়তে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় কমা এবং রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের কারণে রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ জানান, করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবেই পুনরুদ্ধার হয়েছে। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা, পদ্মা সেতুর চালু হওয়া এবং অন্যান্য প্রকল্পগুলোর কারণে বিনিয়োগের জন্য ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলে এফডিআই আরও বাড়বে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হলো ব্র্যান্ডিং এবং বন্দরের অটোমেশন না হওয়া। এগুলো সমাধান হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে। দেশি বিনিয়োগ বাড়ালে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানায়, তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে: মূলধন হিসেবে নগদ বা যন্ত্রপাতি হিসেবে, অর্জিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করে, এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে।
গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যারা মোট বিনিয়োগের ১৭ শতাংশ করেছে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিঙ্গাপুর, ১৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় স্থানে ছিল নেদারল্যান্ডস, ৮ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিসর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ এই পাঁচ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ২৫.১০ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে, যার মধ্যে নিট এফডিআই ১৭.৬৮ বিলিয়ন ডলার।
আইটি সহায়তাঃ টোটাল আইটি সলিউশন